আপনি কি জানেন, গ্রাফিক্স ডিজাইনের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার আছে এবং প্রতিটি প্রকারের নিজস্ব গুরুত্ব? অনেকেই মনে করেন গ্রাফিক্স ডিজাইন মানে শুধু লোগো বানানো বা ছবি এডিট করা। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই আলাদা। গ্রাফিক্স ডিজাইন হল ব্র্যান্ডের গল্প বলার এবং ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
আমি মুহাম্মদ মাহফুজ খান। ৮ বছর আগে যখন আমি গ্রাফিক্স ডিজাইন শুরু করি, তখন আমিও শুধু ছোট ছোট লোগো ডিজাইন করতাম। প্রথম দিকে মনে হতো সব ডিজাইন একই রকম। কিন্তু যখন বিভিন্ন প্রকারের ডিজাইন সম্পর্কে জানলাম এবং শিখলাম, তখনই আমার ফ্রিল্যান্সিং প্রজেক্টে সফলতা আসতে শুরু করে। আজ ৯০০+ সফল প্রজেক্ট শেষ করার পর বুঝেছি, প্রতিটি ডিজাইন প্রকারের আলাদা মূল্য এবং চাহিদা আছে। আজকের এই লেখায় আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করব গ্রাফিক্স ডিজাইনের সকল প্রকার সম্পর্কে বিস্তারিত।
গ্রাফিক্স ডিজাইন কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
গ্রাফিক্স ডিজাইন হল ভিজ্যুয়াল আকারে আইডিয়া বা চিন্তা প্রকাশ করার একটি শিল্প। সহজ ভাষায় বললে, যখন আপনি রঙ, ছবি, টেক্সট এবং আকৃতি ব্যবহার করে কোনো বার্তা পৌঁছে দেন, সেটাই গ্রাফিক্স ডিজাইন।
আমাদের চারপাশে প্রতিদিন হাজারো গ্রাফিক্স ডিজাইনের উদাহরণ দেখি। সকালে যে বিস্কুটের প্যাকেট খুলি, তার ডিজাইন একজন প্যাকেজিং ডিজাইনার করেছেন। ফেসবুকে যে পোস্ট দেখি, সেটা একজন সোশ্যাল মিডিয়া ডিজাইনার তৈরি করেছেন। যে ওয়েবসাইট ব্যবহার করি, তার সুন্দর ইন্টারফেস একজন UI/UX ডিজাইনার বানিয়েছেন।
বাস্তব জীবনে গ্রাফিক্স ডিজাইনের প্রয়োগ অসংখ্য। ব্র্যান্ডিং থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া, অ্যাডভার্টাইজিং, ওয়েব ডিজাইন সবখানেই এর ব্যবহার। একটি ভালো ডিজাইন কোম্পানির বিক্রয় বাড়াতে পারে, ব্র্যান্ডের পরিচিতি দিতে পারে এবং মানুষের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারে।
ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রাফিক্স ডিজাইনের সম্ভাবনাও বিশাল। আপনি চাইলে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাজ করতে পারবেন। ডিজাইন এজেন্সিতে চাকরি করতে পারবেন। নিজের ডিজাইন স্টুডিও খুলতে পারবেন। এমনকি নিজের প্রোডাক্ট তৈরি করে উদ্যোক্তা হতে পারবেন।
“গ্রাফিক্স ডিজাইন শুধু ছবি নয়, এটি ব্র্যান্ডের ভাষা।” – একজন সফল ডিজাইনারের কথায়
গ্রাফিক্স ডিজাইনের মূল দুটি শ্রেণী
গ্রাফিক্স ডিজাইন কত প্রকার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাদের বুঝতে হবে ডিজাইনের মূল দুটি শ্রেণী সম্পর্কে।
স্থির চিত্র বা স্ট্যাটিক গ্রাফিক্স
স্ট্যাটিক গ্রাফিক্স হল এমন ডিজাইন যেগুলো স্থির থাকে, নড়াচড়া করে না। এর মধ্যে আছে লোগো ডিজাইন, পোস্টার, ব্যানার, ব্রোশিওর, ম্যাগাজিন কভার, বিজনেস কার্ড এবং প্রিন্ট ডিজাইনের সব কাজ। এগুলো সাধারণত Adobe Photoshop এবং Illustrator দিয়ে করা হয়। নতুনদের জন্য স্ট্যাটিক ডিজাইন শেখা সহজ এবং এখানে কাজের চাহিদাও অনেক বেশি।
মোশন গ্রাফিক্স
মোশন গ্রাফিক্স কি? এটি হল এমন ডিজাইন যেখানে ছবি, টেক্সট এবং আকৃতি নড়াচড়া করে, অ্যানিমেট হয়। ভিডিও এডিটিং, অ্যানিমেশন, ইন্টারেক্টিভ মিডিয়া, টিভি বিজ্ঞাপন সবই মোশন গ্রাফিক্সের অংশ। এই ধরনের ডিজাইনে After Effects, Premiere Pro এবং Cinema 4D ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে ইউটিউব এবং সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তার কারণে মোশন গ্রাফিক্সের চাহিদা আকাশছোঁয়া।
গ্রাফিক্স ডিজাইনের ৯টি প্রধান প্রকার
এখন আসি মূল আলোচনায়। গ্রাফিক্স ডিজাইন কত প্রকার? প্রধানত ৯ ধরনের গ্রাফিক্স ডিজাইন আছে যেগুলো প্রফেশনাল জগতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
১. ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি ডিজাইন
এটি হল ব্র্যান্ডিং ডিজাইনের মূল ভিত্তি। একটি কোম্পানির লোগো, রঙের ব্যবহার, ফন্ট স্টাইল, বিজনেস কার্ড সবকিছুই ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটির অংশ। যখন আপনি কোকাকোলার লাল রঙ দেখেন বা ম্যাকডোনাল্ডসের হলুদ “M” দেখেন, তখন সাথে সাথে ব্র্যান্ড চিনতে পারেন। এটাই ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটির শক্তি।
আমার ক্যারিয়ারে প্রথম বড় প্রজেক্ট ছিল একটি রেস্তোরাঁর সম্পূর্ণ ব্র্যান্ডিং। লোগো থেকে শুরু করে মেনু কার্ড, ডেলিভারি বক্স সব ডিজাইন করতে হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, একটি ভালো ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি ব্যবসায়ের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রয়োজনীয় স্কিল: টাইপোগ্রাফি, কালার থিওরি, ব্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি
সফটওয়্যার: Adobe Illustrator, Photoshop
ক্যারিয়ার সুযোগ: ব্র্যান্ডিং এজেন্সি, ফ্রিল্যান্সিং, ইন-হাউস ডিজাইনার
২. মার্কেটিং ও অ্যাডভার্টাইজিং ডিজাইন
এই প্রকারের ডিজাইনের মূল লক্ষ্য পণ্য বা সেবা বিক্রি করা। সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, ফেসবুক অ্যাড, গুগল ব্যানার, পোস্টার, ফ্লায়ার সবই মার্কেটিং ডিজাইনের অন্তর্ভুক্ত। একজন মার্কেটিং ডিজাইনারকে শুধু সুন্দর ডিজাইন করলেই হয় না, বুঝতে হয় কোন ডিজাইন মানুষকে কিনতে আগ্রহী করবে।
বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিংের যুগে এই ধরনের ডিজাইনারদের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। প্রতিটি ব্যবসা অনলাইনে তাদের উপস্থিতি বাড়াতে চায়, আর সেজন্য প্রয়োজন আকর্ষণীয় মার্কেটিং ম্যাটেরিয়াল।
প্রয়োজনীয় স্কিল: মার্কেটিং সাইকোলজি, পার্সুয়েসিভ ডিজাইন, ট্রেন্ড এনালাইসিস
সফটওয়্যার: Photoshop, Canva, Figma
ক্যারিয়ার সুযোগ: ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি, ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স কোম্পানি
৩. UI ডিজাইন (ইউজার ইন্টারফেস)
UI ডিজাইন মানে হল ওয়েবসাইট বা মোবাইল অ্যাপের দৃশ্যমান অংশ ডিজাইন করা। বাটন কোথায় থাকবে, রঙ কেমন হবে, ফন্ট কত বড় হবে এসব UI ডিজাইনারের কাজ। একটি সুন্দর UI মানুষকে ওয়েবসাইট বা অ্যাপ ব্যবহার করতে আগ্রহী করে।
টেকনোলজি কোম্পানিগুলোতে UI ডিজাইনারদের সবচেয়ে বেশি চাহিদা। কারণ প্রতিদিন নতুন নতুন অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট তৈরি হচ্ছে। UI এবং UX ডিজাইনের মধ্যে পার্থক্য বুঝলে আপনার ক্যারিয়ার আরও শক্তিশালী হবে।
প্রয়োজনীয় স্কিল: ভিজ্যুয়াল ডিজাইন, ইন্টারেকশন ডিজাইন, রেসপন্সিভ ডিজাইন
সফটওয়্যার: Figma, Adobe XD, Sketch
ক্যারিয়ার সুযোগ: টেক কোম্পানি, স্টার্টআপ, রিমোট জব
৪. UX ডিজাইন (ইউজার এক্সপেরিয়েন্স)
UX ডিজাইন একটু ভিন্ন। এখানে শুধু দেখতে সুন্দর নয়, ব্যবহার করতে কতটা সহজ সেটা গুরুত্বপূর্ণ। একজন UX ডিজাইনার রিসার্চ করেন, ইউজার টেস্টিং করেন এবং ডিজাইন উন্নত করেন যাতে মানুষ সহজে তাদের কাজ সম্পন্ন করতে পারে।
UI এবং UX ডিজাইনের মধ্যে পার্থক্য হল, UI হল কেমন দেখাবে আর UX হল কেমন অনুভব হবে। অনেক সময় দুই কাজই একজন ডিজাইনার করেন, তাকে বলা হয় UI/UX ডিজাইনার।
প্রয়োজনীয় স্কিল: ইউজার রিসার্চ, ওয়্যারফ্রেমিং, প্রোটোটাইপিং, ইউজেবিলিটি টেস্টিং
সফটওয়্যার: Figma, Adobe XD, Axure
ক্যারিয়ার সুযোগ: প্রোডাক্ট কোম্পানি, কনসালটিং, হাই-পেয়িং রিমোট জব
৫. পাবলিকেশন বা প্রকাশনা ডিজাইন
বই, ম্যাগাজিন, নিউজপেপার, ক্যাটালগ এসবের লেআউট এবং ডিজাইন করাই প্রকাশনা ডিজাইন। এখানে টাইপোগ্রাফির জ্ঞান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাঠকদের পড়তে সুবিধা হওয়া এবং দেখতে আকর্ষণীয় লাগা দুটোই দরকার।
ডিজিটাল যুগে প্রকাশনা ডিজাইন অনলাইনেও সম্প্রসারিত হয়েছে। ই-বুক, অনলাইন ম্যাগাজিন, পিডিএফ রিপোর্ট এসবও এখন প্রকাশনা ডিজাইনের অংশ।
প্রয়োজনীয় স্কিল: টাইপোগ্রাফি, পেজ লেআউট, প্রিন্ট ডিজাইন
সফটওয়্যার: Adobe InDesign, Illustrator
ক্যারিয়ার সুযোগ: পাবলিশিং হাউস, ম্যাগাজিন এজেন্সি, ফ্রিল্যান্সিং
৬. প্যাকেজিং ডিজাইন
পণ্যের বাইরের মোড়ক বা প্যাকেজ ডিজাইন করাই হল প্যাকেজিং ডিজাইন। একটি ভালো প্যাকেজিং ডিজাইন পণ্য বিক্রিতে বিশাল ভূমিকা রাখে। দোকানের তাকে হাজারো পণ্যের মধ্যে যেটা সবার আগে চোখে পড়বে, সেটাই জিতবে।
প্যাকেজিং ডিজাইনে শুধু সুন্দর ডিজাইন নয়, প্রিন্টিং প্রসেস, ম্যাটেরিয়াল সিলেকশন এবং কস্ট ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কেও জানতে হয়।
প্রয়োজনীয় স্কিল: প্রোডাক্ট ডিজাইন, প্রিন্ট নলেজ, 3D ডিজাইন
সফটওয়্যার: Illustrator, Photoshop, Cinema 4D
ক্যারিয়ার সুযোগ: FMCG কোম্পানি, প্যাকেজিং এজেন্সি, প্রোডাক্ট স্টার্টআপ
৭. মোশন গ্রাফিক্স ডিজাইন
ভিডিও অ্যানিমেশন, টিভি বিজ্ঞাপন, ইউটিউব ইন্ট্রো, সোশ্যাল মিডিয়া ভিডিও কন্টেন্ট সব মোশন গ্রাফিক্সের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে ভিডিও কন্টেন্টের চাহিদা বাড়ার কারণে মোশন গ্রাফিক্স ডিজাইনাররা খুব ভালো আয় করছেন।
আমি নিজে অনেক ক্লায়েন্টের জন্য ইউটিউব চ্যানেল ব্র্যান্ডিং এবং মোশন গ্রাফিক্স করেছি। এই কাজের জন্য ক্রিয়েটিভিটির পাশাপাশি টেকনিক্যাল দক্ষতাও লাগে।
প্রয়োজনীয় স্কিল: অ্যানিমেশন প্রিন্সিপাল, ভিডিও এডিটিং, সাউন্ড ডিজাইন
সফটওয়্যার: After Effects, Premiere Pro, Cinema 4D
ক্যারিয়ার সুযোগ: মিডিয়া এজেন্সি, ইউটিউব চ্যানেল, ভিডিও প্রোডাকশন
৮. এনভায়রনমেন্টাল গ্রাফিক্স
অফিস, দোকান, মিউজিয়াম, হাসপাতাল এসব জায়গার দেয়াল ডিজাইন, সাইনবোর্ড, ওয়েফাইন্ডিং সিস্টেম এসব এনভায়রনমেন্টাল গ্রাফিক্সের কাজ। এটি ডিজাইন এবং আর্কিটেকচারের মিশ্রণ।
বড় বড় কর্পোরেট অফিস বা শপিং মলে যেসব ইন্সটলেশন দেখি, সেগুলো এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইনারদের কাজ।
প্রয়োজনীয় স্কিল: স্পেশাল ডিজাইন, আর্কিটেকচার বেসিক, ম্যাটেরিয়াল নলেজ
সফটওয়্যার: AutoCAD, SketchUp, Illustrator
ক্যারিয়ার সুযোগ: ডিজাইন ফার্ম, ইভেন্ট কোম্পানি, আর্কিটেকচার স্টুডিও
৯. আর্ট ও ইলাস্ট্রেশন
ডিজিটাল পেইন্টিং, বই ইলাস্ট্রেশন, ক্যারেক্টার ডিজাইন, কমিক আর্ট এসব আর্ট এবং ইলাস্ট্রেশনের অংশ। এটি সবচেয়ে সৃজনশীল ডিজাইন প্রকার। এখানে আপনার নিজস্ব স্টাইল তৈরি করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে NFT আর্ট এবং ডিজিটাল আর্টের জনপ্রিয়তা বাড়ায় ইলাস্ট্রেটরদের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে।প্রয়োজনীয় স্কিল: ড্রইং, কালার থিওরি, ডিজিটাল পেইন্টিং
সফটওয়্যার: Procreate, Illustrator, Photoshop
ক্যারিয়ার সুযোগ: ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট, বুক ইলাস্ট্রেশন, গেম ডিজাইন
অতিরিক্ত উদীয়মান গ্রাফিক্স ডিজাইনের ধরন
প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে নতুন নতুন ধরনের ডিজাইনও জনপ্রিয় হচ্ছে।
ইনফোগ্রাফিক ডিজাইন: জটিল তথ্য সহজভাবে ভিজ্যুয়াল আকারে উপস্থাপন করা। কন্টেন্ট মার্কেটিংয়ে ইনফোগ্রাফিকের চাহিদা অনেক।
টাইপোগ্রাফি ডিজাইন: শুধুমাত্র অক্ষর এবং ফন্ট নিয়ে কাজ করা। কাস্টম ফন্ট ডিজাইন, লেটারিং আর্ট এসব এর অন্তর্ভুক্ত।3D গ্রাফিক্স ডিজাইন: তিন মাত্রিক ডিজাইন তৈরি করা। প্রোডাক্ট ভিজুয়ালাইজেশন, আর্কিটেকচারাল রেন্ডারিং, গেম ডিজাইনে 3D ডিজাইনের ব্যবহার ব্যাপক। Blender এবং Cinema 4D দিয়ে এই কাজ করা হয়।
কীভাবে সঠিক গ্রাফিক্স ডিজাইন প্রকার বেছে নেবেন?
এতগুলো প্রকার দেখে হয়তো আপনি ভাবছেন, আমার জন্য কোনটা সঠিক? এখানে কিছু টিপস দিচ্ছি:
আগ্রহ চিহ্নিত করুন: আপনি কি বেশি সৃজনশীল কাজ পছন্দ করেন নাকি টেকনিক্যাল কাজ? আর্ট পছন্দ হলে ইলাস্ট্রেশন, টেকনোলজি পছন্দ হলে UI/UX বেছে নিন।
বাজার চাহিদা বিশ্লেষণ করুন: ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে কোন ধরনের কাজের চাহিদা বেশি দেখুন। বাংলাদেশে UI/UX, সোশ্যাল মিডিয়া ডিজাইন এবং ব্র্যান্ডিং ডিজাইনের চাহিদা খুব বেশি।
প্রয়োজনীয় স্কিল চেক করুন: যে ধরনের ডিজাইন শিখতে চান, সেখানে কী কী স্কিল লাগবে তা দেখুন এবং সেগুলো শেখার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
পোর্টফোলিও তৈরি করুন: নিজের কাজের নমুনা তৈরি করুন। শুরুতে ফ্রিতে কিছু প্রজেক্ট করে অভিজ্ঞতা নিন।
| ডিজাইন টাইপ | শেখার সময় | ইনকাম পটেনশিয়াল | শুরুর সহজতা |
| লোগো ডিজাইন | ২-৩ মাস | মাঝারি | সহজ |
| UI/UX ডিজাইন | ৬-৮ মাস | উচ্চ | মাঝারি |
| মোশন গ্রাফিক্স | ৮-১২ মাস | উচ্চ | কঠিন |
| সোশ্যাল মিডিয়া ডিজাইন | ১-২ মাস | মাঝারি | খুব সহজ |
| প্যাকেজিং ডিজাইন | ৪-৬ মাস | উচ্চ | মাঝারি |
| ইলাস্ট্রেশন | ৬-১২ মাস | মাঝারি-উচ্চ | মাঝারি |
গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখার সেরা উপায়
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, গ্রাফিক ডিজাইন শিখতে কত দিন লাগে? এর উত্তর নির্ভর করে আপনি কোন প্রকার শিখছেন এবং কতটা সময় দিচ্ছেন তার ওপর। তবে সাধারণত বেসিক লেভেলে দক্ষ হতে ৩ থেকে ৬ মাস লাগে।
মৌলিক থিওরি শিখুন
ডিজাইনের বেসিক জিনিস যেমন কালার থিওরি, টাইপোগ্রাফি, কম্পোজিশন, হোয়াইট স্পেস এসব প্রথমে বুঝতে হবে। এগুলো যত ভালো বুঝবেন, ডিজাইন তত ভালো হবে। রঙের মনোবিজ্ঞান জানা খুব জরুরি কারণ প্রতিটি রঙ মানুষের মনে ভিন্ন অনুভূতি তৈরি করে। লাল রঙ উত্তেজনা, নীল শান্তি আর সবুজ প্রকৃতির অনুভূতি দেয়।
সফটওয়্যার মাস্টারি করুন
Adobe Photoshop ছবি এডিটিং এবং ডিজিটাল পেইন্টিংয়ের জন্য সেরা। Adobe Illustrator ভেক্টর ডিজাইন যেমন লোগো, আইকন, ইলাস্ট্রেশনের জন্য। Figma হল UI/UX ডিজাইনের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় টুল এবং এটি ফ্রিতে ব্যবহার করা যায়। প্রতিটি টুলের ইউটিউবে হাজারো ফ্রি টিউটোরিয়াল আছে।
অনলাইন কোর্স করুন
বাংলাদেশে Creative Ittefaq, Bohubrihi, 10 Minute School-এ ভালো মানের বাংলা কোর্স পাবেন। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে Udemy, Coursera, Skillshare-এ বিশ্বমানের কোর্স আছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, একটা ভালো কোর্স আপনার শেখার সময় অর্ধেক কমিয়ে দেয়।
প্র্যাকটিস প্রজেক্ট করুন
শুধু ভিডিও দেখলে হবে না, নিজে নিজে প্রজেক্ট করতে হবে। প্রথমে বিখ্যাত ডিজাইন কপি করে শিখুন। তারপর নিজের আইডিয়া দিয়ে ডিজাইন করুন। Behance এবং Dribbble-এ অন্যদের কাজ দেখে অনুপ্রেরণা নিন।
পোর্টফোলিও তৈরি করুন
আপনার সেরা ৫-১০টা কাজ একটা পোর্টফোলিও ওয়েবসাইটে রাখুন। Behance বা নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে পারেন। ক্লায়েন্ট পোর্টফোলিও দেখেই কাজ দেয় কিনা ঠিক করে।
ফ্রিল্যান্সিং শুরু করুন
Fiverr, Upwork, Freelancer.com এসব প্ল্যাটফর্মে প্রোফাইল খুলে ছোট ছোট প্রজেক্ট দিয়ে শুরু করুন। প্রথম দিকে কম দামে কাজ করতে হতে পারে, কিন্তু রিভিউ পেলে পরে ভালো দামে কাজ পাবেন।
সারসংক্ষেপ ও পরবর্তী পদক্ষেপ
আজকের আলোচনায় আমরা দেখলাম গ্রাফিক্স ডিজাইন কত প্রকার এবং প্রতিটি প্রকারের বিশেষত্ব কী। মূল ৯টি প্রকার হল ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি, মার্কেটিং, UI, UX, প্রকাশনা, প্যাকেজিং, মোশন গ্রাফিক্স, এনভায়রনমেন্টাল এবং ইলাস্ট্রেশন।
প্রতিটি প্রকারেরই নিজস্ব চাহিদা এবং ক্যারিয়ারের সুযোগ আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আপনার আগ্রহ এবং লক্ষ্য বুঝে সঠিক প্রকার বেছে নেওয়া। শুরুতে একটা প্রকারে ফোকাস করুন, ভালোভাবে শিখুন। তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী অন্যান্য প্রকার শিখতে পারবেন।
আমার ৮ বছরের যাত্রায় একটা জিনিস বুঝেছি – ডিজাইন শেখার কোনো শেষ নেই। প্রতিদিন নতুন কিছু শেখার আছে। ট্রেন্ড বদলায়, টুল আপডেট হয়। তাই শেখা চালিয়ে যেতে হবে।
আজই শুরু করুন আপনার গ্রাফিক্স ডিজাইন যাত্রা! যে প্রকার আপনার ভালো লাগছে, সেখান থেকে শুরু করুন। ইউটিউবে ফ্রি টিউটোরিয়াল দেখুন। Canva দিয়ে প্র্যাকটিস করুন। ধীরে ধীরে Adobe সফটওয়্যার শিখুন। নিয়মিত প্র্যাকটিস করুন। পোর্টফোলিও বানান। ফ্রিল্যান্সিং শুরু করুন।
মনে রাখবেন, প্রতিটি সফল ডিজাইনারই একদিন শূন্য থেকে শুরু করেছিল। আপনিও পারবেন। শুধু প্রয়োজন ধৈর্য, লেগে থাকা এবং ক্রমাগত শেখার মানসিকতা। গ্রাফিক্স ডিজাইনের বিশাল জগতে আপনাকে স্বাগতম। শুভকামনা রইল আপনার ডিজাইন ক্যারিয়ারের জন্য!
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
গ্রাফিক্স ডিজাইনের প্রধানত ৯ প্রকার আছে: ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি ডিজাইন, মার্কেটিং ডিজাইন, UI ডিজাইন, UX ডিজাইন, প্রকাশনা ডিজাইন, প্যাকেজিং ডিজাইন, মোশন গ্রাফিক্স, এনভায়রনমেন্টাল গ্রাফিক্স এবং আর্ট ও ইলাস্ট্রেশন। এছাড়া ইনফোগ্রাফিক, টাইপোগ্রাফি এবং 3D ডিজাইনও জনপ্রিয় হচ্ছে।
UI/UX ডিজাইন এবং মোশন গ্রাফিক্সে আয় সবচেয়ে বেশি। একজন অভিজ্ঞ UI/UX ডিজাইনার মাসে ৫০ হাজার থেকে কয়েক লক্ষ টাকা আয় করতে পারেন। ব্র্যান্ডিং এবং প্যাকেজিং ডিজাইনেও ভালো আয়ের সুযোগ আছে। তবে মনে রাখবেন, আয় নির্ভর করে আপনার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার ওপর।
বেসিক লেভেলে দক্ষ হতে ৩ থেকে ৬ মাস লাগে। তবে প্রফেশনাল হতে চাইলে ১ থেকে ২ বছর লাগতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া ডিজাইনের মতো সহজ বিষয় ১-২ মাসেই শেখা যায়। কিন্তু UI/UX বা মোশন গ্রাফিক্সের মতো জটিল বিষয় শিখতে ৬-১২ মাস সময় দিতে হয়। নিয়মিত প্র্যাকটিস করলে দ্রুত শিখতে পারবেন।
অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-কমার্স এবং স্টার্টআপের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সবাই ভালো ডিজাইনার খুঁজছে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশি ডিজাইনাররা বিশ্বজুড়ে কাজ করছে। Fiverr-এ অনেক বাংলাদেশি ডিজাইনার Top Rated Seller। এছাড়া দেশীয় কোম্পানিগুলোতেও ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ আছে। আমার নিজের ৮ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দক্ষতা থাকলে কাজের অভাব নেই।
হ্যাঁ, সম্ভব। বেসিক লেভেলের ডিজাইন যেমন সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, সিম্পল লোগো মোবাইল দিয়ে করা যায়। Canva, Adobe Spark, Over, PixelLab এসব অ্যাপ ব্যবহার করতে পারবেন। তবে প্রফেশনাল কাজের জন্য কম্পিউটার এবং Adobe সফটওয়্যার জরুরি। ট্যাবলেটে Procreate দিয়ে ইলাস্ট্রেশন করা যায় চমৎকার। শুরুটা মোবাইল দিয়ে করতে পারেন, তবে সিরিয়াস হলে কম্পিউটারে যেতে হবে।